ARTICLE
6 September 2024

রাষ্ট্রধর্ম এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা - সাংবিধানিক টানাপোড়ন বনাম টানাপোড়নের সংবিধান

VC
Vertex Chambers

Contributor

Vertex Chambers is a Bangladeshi law firm ranked as a "Top Tier" firm for Tax in The Legal500 Asia Pacific 2022 edition. Our firm specializes in tax, corporate, commercial, finance, energy and litigation matters. Each of our partners has over a decade's experience in legal practice.
১। বাংলাদেশের সংবিধান প্রনীত হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে।
Bangladesh Government, Public Sector
To print this article, all you need is to be registered or login on Mondaq.com.

১। বাংলাদেশের সংবিধান প্রনীত হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে। প্রখ্যাত সিনিয়র আইনজীবী এবং বাংলাদেশের প্রাক্তন এটর্নী জেনারেল মরহুম মাহমুদুল ইসলাম বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানকে একটি বলিষ্ঠ দলিল (robust document) হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন (কন্সটিটিউসনাল ল অফ বাংলাদেশ, প্রথম সংস্করণ,মল্লিক ব্রাদারস, ১৯৯৫ )। মরহুম মাহমুদুল ইসলাম যথার্থই লিখেছিলেন। প্রায় চব্বিশ বছর ধরে নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে স্বাধীনতার মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে প্রণীত একটি দলিল- যা তৎকালীন প্রায় ৭ কোটি মানুষের আত্ম-নির্ধারণ এর পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে- সেটিকে বলিষ্ঠ (robust) বলা ছাড়া অন্য কিছু বললে খাটো করা হবে।

২। ১৯৭২ এর সংবিধানের ৪ টি মুলনীতির অন্যতম হলো ধর্ম নিরপেক্ষতা (secularism)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঘৃণ্য হত্যার পরবর্তী সাংবিধানিক কর্মসূচী বাংলাদেশের সংবিধানে দুটি প্রধান ধর্মভিত্তিক বিষয় এবং অনুচ্ছেদ সংযোজন করে - সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এর সন্নিবেশন এবং ৮ম সংশোধনীর অধিনে অনুচ্ছেদ ২ক এর মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা ইসলামের সংযোজন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, আনোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ মামলায় (সংবিধানের ৮ম সংশোধনী মামলা হিসেবে পরিচিত) আপীল বিভাগ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর অধীনে সংযোজিত অনুচ্ছেদ ২ক এর বৈধতা নিয়ে কোন রায় প্রদান করেনি।

৩। এই প্রবন্ধের মূল আলোচনা হলো সম্প্রতি প্রকাশিত স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি বনাম বাংলাদেশ (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৩৪/১৯৮৮) মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক এর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এর বৈধতা সংক্রান্ত বিষয়। রায়ের সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রদান করা হয়েছে। বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল এর সংখ্যালঘু রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের উপসংহারের সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের আইনি বিশ্লেষণের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। হাইকোর্ট বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় মোতাবেক সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরস্পর বিরোধী নয় এবং এই দুই মতবাদ সহাবস্থান করতে পারে। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা প্রদান করেছে তবে সাংবিধানিক ইতিহাস পর্যালোচনা করেনি। এই প্রবন্ধে আমি বিষয়টিকে সাংবিধানিক ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশেষ করে ১৯৭২ সালের ১২ই অক্টোবর থেকে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের গণপরিষদের বিতর্কের উপর ভিত্তি করে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছি। সাংবিধানিক ইতিহাস হলো সেই তথ্য-উপাত্ত যার উপর ভিত্তি করে কোন সংবিধান বা সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদের অর্থ বা ব্যাখ্যা বোঝা যায়।

৪। মোটাদাগে, ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে গণপরিষদের বিতর্কে যা আলোচনা হয়েছে তা হলো নিম্নরূপ :

(ক) ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে ; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ_-যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২০)

(খ) ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এমনই এক আদর্শ, যা না গ্রহণ করলে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র কোনদিনই গ্রহন করা যায় না। আমরা এমন একটা মানবগোষ্ঠী এই ৫8 হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে, যাদের ভাষা এক, যাদের জীবন ও ধ্যান-ধারণার বোধ এক, কিন্তু ধর্ম বিভিন্ন । (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ১২৭)

(গ) ইসলাম ধর্মের চিরন্তন বাণী হচ্ছে "আমার ধর্ম আমার জন্য, তোমার ধর্ম তোমার জন্য"("লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন")। এই মূলনীতি সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে। এই গ্যারান্টি দেওয়া যে, ব্যক্তি-জীবনে যার যেটুকু ধর্ম, সে সেই ধর্ম অনুসরন করবে, অনুশীলন করবে। কেউ তাতে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারবে না। কিন্তু ধর্মকে যাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা না যায়, সংবিধানে তারও নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। (মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ১৫১)

৫। গণপরিষদের ধর্ম নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত আলোচনাসমূহের মধ্যে নিম্নের উক্তিটি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ -

... এই সংবিধানে সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য সম-অধিকার বেঁধে দেওয়া হরেছে। আমার ধর্মকে আমি স্বীকার করি, তোমার ধর্মকে তুমি স্বীকার কর। 'লাকুম দীনুকুম ওরালিইয়া দীন'। যার ধর্ম, তার কাছে। 'লা ইকরাহ ফিদ্দীন।' ধর্মে কোন জবরদস্তী নাই। যুগোপযোগী এই ধর্ম, কাউকে কোন রকম বাধ্য করা, কাউকে কোন প্রকার অত্যাচার করা, অবিচার করাকে সমর্থন করে না। ... এই ধর্মের যে মূল উদ্দেশ্য, তা এতদিন প্রতিপালিত হয় নাই। ইসলামের নামে পাকিস্তানের বর্বর, স্বৈরাচারী পশুরা একরাত্রে বাঙালীদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। ... তারপর, তারা যখন চলে, যাচ্ছিল, তখন মেশিনগান দিয়ে তাদের মাথা গুঁড়া করে দেওয়া হয়েছিল। এক কোটি নিরপরাধ, 'বেগুনাহ¬' মানুষকে দেশ থেকে ধাক্কা দিরে বের করে দেওয়া হয়েছিল! ... শুধু তাই নয় – তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জৎ ধ্বংস করেছিল যারা, তারা বলেছে, আমরা মুসলমান; আমরা এ সব করেছিলাম ইসলাম রক্ষা করার জন্য। কিন্ত তখন সোভিয়েট রাশিয়ার মতো দেশ মানবতাকে রক্ষার জন্য যেভাবে সাহায্য করেছিল, নিরাপত্তা পরিষদে একবার নয়, দুইবার নয়- তিন-তিনবার যেভাবে ভিটো দিয়েছিল, সেটা যদি না দিত, না জানি আজ বাংলার অবস্থা কী দাঁড়াত। সেই সোভিয়েট রাশিয়াকে যদি ধর্মহীন বলা হয়, আর পাঞ্জাবী সৈনিকদের যদি মুসলমান বলা হয়, বলা হয় ইসলামধর্মাবলম্বী, তাহলে আল্লার নামে বলতে চাই, সেই ধর্মের প্রয়োনীয়তা নাই। কিন্তু তারা ধোকাবাজ, ইসলামের নামে ফাঁকি দিয়েছে। যারা সত্যিকারভাবে ইসলামকে প্রতিপালন করতে চায়, তারা কস্মিনকালেও এটা করতে পারে না।''(মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৪০৩)

৬। সাংবিধানিক ইতিহাস থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিধি সম্পর্কে আমরা নিম্নের ধারণা পাই-

"ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মের অপব্যবহার ... বন্ধ করে ... মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে ..." (আছাদুজ্জামান খান, গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২৬৩)

৭। "রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান" কথাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এই কথাগুলো খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ কামাল হোসেনের এর বক্তৃতায়ও স্থান পেয়েছিল (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২৫)।

৮। গণপরিষদের বিতর্কে দেখা যায় যে ধর্ম নিরপেক্ষতার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখা (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ১২৮) এবং তার কারণ ছিল ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা যাতে বাংলাদেশে মাথা তুলে দাড়াতে না পারে (এম শামসুল হক, গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৩৫৩)।

৯। গণপরিষদের বক্তৃতায় ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপিত হয়। ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে শোষিত একটি জাতির আত্মপরিচয় ছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ যার উৎস ছিল বাংলাদেশের মানুষের ভৌগলিক অবস্থান, চরিত্র, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ। এ এইচ এম কামারুজ্জামান এটিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২৯৯)-

"বাংলার মানুষ অতীতে ধর্মান্ধতার বশীভূত হয়ে আত্মকলহে লিপ্ত হয় এবং ভাই ভাইয়ের উপর ছুরি চালায়। কিন্তু কোন দেশ বা জাতি নিছক ধর্মের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয় না। দেশ বা জাতি গঠিত হয় সে অঞ্চলের মানুষের সামগ্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভৌগোলীক অখণ্ডতা, মানবিক চরিত্র, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে। তাই বাংলার মানুষ একটি গোটা জাতি এবং একই জাতির মধ্যে কোন দিন ... ধর্ম অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে না।''

১০। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো (basic structure) হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম (খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস, আপীল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট)। সে হিসেবে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সাংবিধানিক পন্থায় বদলানো যাবে না (খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস, আপীল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট)। তাহলে প্রশ্ন হলো, যদি ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো তত্ত্বের একটি অংশ হয়, তবে কোন ভিত্তিতে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম সংবিধানে স্থান পায়?

১১। এক্ষেত্রে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি বনাম বাংলাদেশ (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৩৪/১৯৮৮) মামলার ৩৮ অনুচ্ছেদে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় পর্যবেক্ষণ করে যে রাজনৈতিক পরিভাষায়, ধর্মনিরপেক্ষতা হল ধর্ম ও সরকারকে আলাদা করার জন্য একটি আন্দোলন, যাকে প্রায়ই চার্চপ্রথা এবং রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ বলা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের মতে সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ "ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা" নিয়ে কাজ করে যার অর্থ হল আমাদের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ধর্মের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং সম্মান করে। তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের মতে ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরন ধর্মের বিনিময়ে করা যাবে না। কিভাবে "ধর্মনিরপেক্ষতা" নিশ্চিত করা হবে তা সংবিধানের ১২(ক )-১২(ঘ ) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়েছে যে "রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান" বিলোপ করার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় মোতাবেক অনুচ্ছেদ ১২, "প্রতিষ্ঠাপিত রাষ্ট্রধর্ম" (state religion with establishment) কে অনুমোদন দেয় না কারণ "প্রতিষ্ঠাপিত রাষ্ট্রধর্ম" অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রধর্মকে উচ্চতর অবস্থানে রাখে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় আরও পর্যবেক্ষণ করে যে, অনুচ্ছেদ ১২ রাষ্ট্রের উপর একটি বাধ্যবাধকতা আরোপ করে যাতে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য করতে না পারে কারণ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো রাষ্ট্রের আধিপত্যকে (Supremacy of State) বাধ্যতামূলক করে। এই সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় ১৮ অনুচ্ছেদে ধর্মের প্রতিষ্ঠাপন সম্বলিত স্বীকৃতি (recognition with establishment) এবং প্রতিষ্ঠাপন ব্যতিরেকে স্বীকৃতি (recognition without establishment) নামের দুটি তত্ত্বের উপর আলোকপাত করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় ২৭ অনুচ্ছেদে পর্যবেক্ষণ করে যে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক হলো ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাপন ব্যতিরেকে স্বীকৃতি (recognition without establishment) কারণ এটি রাষ্ট্রকে সকল ধর্মের "সমান মর্যাদা এবং অনুশীলনে সমান অধিকার" (equal status and equal right in practice) নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রদান করে এবং অনুচ্ছেদ ২ক "সম" (equal) শব্দটি ব্যবহার দ্বারা ইসলাম ধর্মকে অন্যান্য সকল ধর্মের সাথে সমাবস্থানে রাখে ।

১২। স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি বনাম বাংলাদেশ (রিট পিটিশন নম্বর ১৪৩৪/১৯৮৮) মামলার সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক সবিনয় নিবেদন হলো উক্ত রায়ের পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে। এর তিনটি কারণ রয়েছে।

১৩। প্রথমত, সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এর সংযোজনকে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলতে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে বাংলাদেশের সংবিধানের ২ক তে "সম" (equal) শব্দের ব্যবহারের ফলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অন্যান্য ধর্মের তুলনায় কোন আলাদা শ্রেষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয়নি (সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ২৫ এবং ২৭ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু, ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মকে অনুচ্ছেদ ২ক রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। এই তফাৎটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মনে রাখা জরুরী । ধারা ২ক বলে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় "সমমর্যাদা" বা ইংরেজিতে equal status শব্দগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন এই বলে যে, অন্যান্য সকল ধর্মকে ইসলাম ধর্মের সাথে সমাবস্থানে রাখা হয়েছে (সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ২৭ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক সেকথা বলেনা। এখানে বলে রাখা জরুরী যে, অনুচ্ছেদ ২ক প্রবর্তনের হেতুসংক্রান্ত কোন ঐতিহাসিক নথি (গণপরিষদের বিতর্কের মতন) নেই। সুতরাং, অনুচ্ছেদ ২ক এর শাব্দিক ব্যাখ্যা ঐতিহাসিক কোন সরকারী দলিল দ্বারা করা যায় না। অনুচ্ছেদ ২ক বলে ইসলাম ছাড়া "অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন" । এখানে "পালন" শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ । সংবিধানের ইংরেজী সংস্করণে "পালন'' বলতে লেখা হয়েছে "in the practice of"। সুতরাং, এটা তর্কযোগ্য যে, অনুচ্ছেদ ২ক এর অধীনে, অন্যান্য ধর্মের "সমমর্যাদা" শুধু উক্ত ধর্মের প্রায়োগিক দিকের সাথে সম্পর্কিত, স্বিকৃতির সাথে নয়। অনুচ্ছেদ ২ক বলে না যে প্রজাতন্তের রাষ্ট্রধর্ম একাধিক। অনেক দেশেই একাধিক রাষ্ট্রধর্মের বা ধর্মব্যবস্থার স্বিকৃতি রয়েছে (যেমন ফিনল্যান্ডে ইভাঞ্জেলিক্যাল লুথেরান চার্চ এবং অর্থোডক্স চার্চ আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দুটি রাষ্ট্রীয় চার্চ ব্যবস্থা)। অন্য কথায়, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক মোতাবেক প্রজাতন্তের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বিকৃতি পেয়েছে কেবল ইসলাম। অর্থাৎ, সাংবিধানিক ভাবে "স্বিকৃতির মর্যাদা'' পেয়েছে কেবলমাত্র ইসলাম; অন্য কোন ধর্ম নয়, এবং অন্যান্য ধর্ম সমমর্যাদা পেয়েছে "ধর্মপালনের" ক্ষেত্রে, স্বিকৃতির ক্ষেত্রে নয়। অস্ট্রেলিয়ার হাইকোর্ট এর অ্যাটর্নি-জেনারেল বনাম কমনওয়েলথ মামলায় বিচারপতি উইলসন ধর্মের "প্রতিষ্ঠাপন" (establishment) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, কোন একটি ধর্মের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইচ্ছাকৃত নির্বাচন (deliberate selection of one to be preferred from among others) হলেই সেই ধর্মের প্রতিষ্ঠাপন হয়ে যায়, এবং বিচারপতি মেইসন বলেছিলেন যে, একটি ধর্মের রাষ্ট্রীয় বা সাংবিধানিক নির্বাচন অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানের ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠাপন নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন করবে । সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় ধর্মের প্রতিষ্ঠাপন সংক্রান্ত এই সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য কোন আইনি নজীরের মাধ্যমে আলোচনা করেনি। গণপরিষদের বিতর্কে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ কামাল হোসেন পর্যবেক্ষণ করেন যে, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী বাংলাদেশে "সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ ফল আমরা দেখেছি" এবং তৎকালীন খসড়া সংবিধানে "সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান ... বিলোপ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে" (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২৫)। একই কথা আছাদুজ্জামান খান তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২৬৩)। সুতরাং গণপরিষদের বিতর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, অনুচ্ছেদ ২ক-তে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের স্বিকৃতি ''রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান'' হয়ে যায়, যা হিন্দু/খ্রিস্টান/বৌদ্ধ ধর্মকে দেয়া হয়নি । এবং এই স্বিকৃতির "মর্যাদা দান" গণপরিষদের বিতর্ক অনুসারে ধর্ম নিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যা সুপ্রিম কোর্টের খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস মামলার সংবিধানের মৌলিক কাঠামো তত্ত্ব অনুসারে অনুচ্ছেদ ২ক-কে অবৈধ করে দেয় ।

১৪। দ্বিতীয়ত , সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় মোতাবেক, অনুচ্ছেদ ২ক সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল নীতিমালাসমূহ, বা সংবিধানের অন্য কোনো বিধানকে বিক্ষুব্ধ করে না কারণ শুধুমাত্র "রাষ্ট্রধর্ম" হিসেবে ইসলাম ধর্মকে স্বীকৃতি প্রদান রাষ্ট্র কর্তৃক ইসলামকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়ার সমতুল্য নয় এবং ইসলামের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সন্নিবেশণ হওয়ায় ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বীদের সাংবিধানিক অধিকারকে প্রভাবিত করে না (সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ৩৯ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। এক্ষেত্রে গণপরিষদের বিতর্কে ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত আলোচনা সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের পর্যবেক্ষণের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অনুচ্ছেদ ১২(খ) এর অভিব্যক্তি "রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান'' এর উদ্দেশ্য ছিল "ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখা" (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ১২৮) । যদি অনুচ্ছেদ ২ক-তে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বিকৃতি দেয়া হয়, তাহলে ধর্ম রাজনীতিতে বা রাষ্ট্র কাঠামোতে প্রবেশ করবে যা গণপরিষদের ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত আলোচনা অনুসারে কখনই কাম্য ছিলো না। গণপরিষদের ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত বিতর্ক ইঙ্গিত করে যে, ধর্ম, বিশ্বাস এবং ধর্মকর্ম নিতান্তই একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তাঁর বক্তব্যে বলেন (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৭০২)-

"মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে - কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে - তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।''

১৫। ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ অন্যান্য মুসলিম দেশেও দেখা গেছে। উদাহরণসরূপ, ১৯৩৭ সালে তুরস্কের সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন সংক্রান্ত গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বিতর্কে তৎকালীন মুগ্লা প্রদেশের সাংসদ এবং অভ্যন্তরীণ মন্ত্রি সুক্রু কায়া বলেন (তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সংসদীয় রেকর্ড, XXXIII, ভলিউম ১ (২রা মে ১৯৩৭), পৃষ্ঠা ৬০)-

"আমরা জনগণকে তাদের বিবেক ও তাদের ইচ্ছামত বিশ্বাস মেনে চলার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সামান্যতম চাপ দিচ্ছি না । সবার বিবেক মুক্ত। আমরা যে স্বাধীনতা চাই এবং ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্দেশ্য হল ধর্ম যাতে রাষ্ট্রীয় বিষয় প্রভাবিত করতে বা উক্ত বিষয়ের একটি হেতু হতে না পারে তা নিশ্চিত করা... আমরা শুধু বলছি ধর্ম রয়ে যাবে উপাসনালয়ে এবং বিবেকের মধ্যে এবং তা বস্তুগত জীবনে এবং বৈশ্বিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।''

১৬। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষতা বোঝাতে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাগণ তুরস্কের মতন একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত ধর্মীয় ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছেন যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন হস্তক্ষেপ থাকবেনা। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বিকৃতি দেয়াটাকে কোন রাজনৈতিক মর্যাদা দেয়া হয়নি বলে যে পর্যবেক্ষণ করেছে (সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ৩৯ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য), তা গণপরিষদের বিতর্কে ধর্মকে সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ার যাতে না হয় সে উদ্দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের বা রাজনীতির বাইরে নিতান্ত ব্যক্তিপর্যায়ের একটি বিষয় হিসেবে রাখার যে স্পৃহা , সেটার সাথে মেলানো যায় না।

১৭। তৃতীয়ত, সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় কর্তৃক অনুচ্ছেদ ২ক-কে ধর্মের প্রতিষ্ঠাপন ব্যতিরেকে স্বীকৃতি (recognition without establishment) তত্ত্বের ছকে ফেলার প্রচেষ্টা (সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ১৮ এবং ২৭ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) উক্ত তত্ত্বের তুলনামূলক রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক ইতিহাসের গুরুত্ব আমলে নেয়নি। এটা মনে রাখা জরুরী যে, ধর্মের প্রতিষ্ঠাপন ব্যতিরেকে স্বীকৃতি (recognition without establishment) তত্ত্বটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে বা বিভিন্ন মাত্রায় দেখা যায় এবং এই বিভিন্ন রূপ বা মাত্রা নির্ভর করে কোন দেশের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক ইতিহাসের উপর। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার উদাহরণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক । মালয়েশিয়ার সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম স্বিকৃত তবে অন্যান্য ধর্ম সেই রাষ্ট্রের যেকোনো অংশে শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে পালন করা যেতে পারে (Islam is the religion of the Federation; but other religions may be practised in peace and harmony in any part of the Federation)। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে রীড কমিশনের রিপোর্ট এ (যা মালয়েশিয়া ফেডারেশনের সাংবিধানিক কমিশনের রিপোর্ট হিসেবে পরিচিত) পর্যবেক্ষণ করা হয় যে, যদিও মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হবে তথাপি মালয়েশিয়া একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হবে (রীড কমিশনের রিপোর্ট, অনুচ্ছেদ ১৬৯)। সুতরাং, মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাস দেখায় যে, সেই দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়া সত্ত্বেও মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট বিখ্যাত চে ওমর চে সো বনাম পাবলিক প্রসিকিউটর মামলায় একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। অন্য কথায়, মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের উদাহরন সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে ধর্মের প্রতিষ্ঠাপন ব্যতিরেকে স্বীকৃতি (recognition without establishment) তত্ত্বের একটি যুতসই উদাহরন। কিন্ত বাংলাদেশে ধর্ম সংক্রান্ত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাস মালয়েশিয়ার ইতিহাসের মতন তেমন মসৃণ নয়। আদতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ববর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসে ধর্মকে সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে । জনাব আব্দুল মালেক উকিল গণপরিষদের বিতর্কে বলেন – "ধর্মের নামে ব্যভিচার হয়েছে, শোষণ হয়েছে দেশে'' (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২৪১)। সুতরাং, সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংক্রান্ত অনুচ্ছেদটিকে ধর্মের প্রতিষ্ঠাপন ব্যতিরেকে স্বীকৃতি (recognition without establishment) তত্ত্বের মোড়কে ফেলা বাংলাদেশে স্বাধীনতাপূর্ব ধর্মভিত্তিক শোষণের এবং সাম্প্রদায়িকতার যে ইতিহাস, এবং সে ইতিহাসের জাতীগত যে মানসিক ক্ষত বা ট্রমা, সেটাকে উপেক্ষা করা হয়েছে । গণপরিষদের বিতর্কে আমরা সেই ঐতিহাসিক জাতীগত ট্রমার প্রতিফলন দেখতে পাই যা সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে প্রতিফলিত হয়নি।

১৮। তাজউদ্দিন আহমেদ গণপরিষদের বিতর্কে পর্যবেক্ষণ করেন যে, বাঙ্গালি জাতির আন্দোলন হয়েছিল "বাংলাদেশের ভাষা, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি আদায় এবং প্রতিষ্ঠার জন্য" (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৩৮২) । সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ হলো "ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বেড়াজাল ভেঙে ... নতুন ধর্মনিরপেক্ষ, বাংলা-ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ" (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৬৯২)। এই যে ধর্ম এবং ভাষার মধ্যে টানাপোড়ন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব ইতিহাস একটি নির্দিষ্ট ভাষানির্ভর জনগোষ্ঠীর উপর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মের সাম্প্রদায়িক ব্যবহার এবং ধর্মের নামে অত্যাচার দেখায়, সে প্রেক্ষাপট গণপরিষদের বিতর্কে উঠে এসেছে যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক-কে বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোর একটি অনাহূত বিষয় করে তোলে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২ক দ্বারা রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের সন্নিবেশন একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, যা বাংলাদেশের সাংবিধানিক মূল কাঠামোর পরিপন্থি।

১৯। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২ক বাতিল করা হয়নি। হয়তোবা সেটি বর্তমান সরকারের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে, সকল সাংবিধানিক সিদ্ধান্তই কিছুটা এবং ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোপরি রাজনৈতিক, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণে নেয়া হয়। এতে দোষের কিছু নেই। তাজউদ্দিন আহমেদ গণপরিষদের বিতর্কে বলেছিলেন (গণপরিষদের বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৩৮৩)-

"অনেকেই বলেন, সংবিধানে অমুক কথা নাই, অমুক কথা থাকলে সুবিধা হত। কিন্তু আজকের দিনে, এই বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দাঁড়িয়ে ১০০ বৎসর পরে কী হবে, ৫০ বৎসর পরে কী হবে, ২৫ বৎসর পরে কী হবে, তা যদি বুঝতে পারতাম এবং সে সব সম্বন্ধে বিধানসমূহ এই বিলে সংযোজিত করতে পারতাম, তাহলে অবশ্যই একটা কাজের মতো কাজ করেছি বলে দাবী করতে পারতাম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আজকের দিনে আমরা যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিবেচনা করছি, আগামী দিনে তা অপাংক্তেয় হয়ে দাঁড়াতে পারে, আগামী দিনে তা জাতির অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।''

২০। কালের বিবর্তনে এবং সামাজিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সংযোজন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সবিনয়ে বলছি, সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২ক এর অবস্থিতির পেছনে যদি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণ থাকে, তবে সে কারণটি ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সাংবিধানিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এবং সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ৭খ অনুচ্ছেদ সংযোজনের কারণে আদালতের উক্ত ত্রুটি শোধরানোর সাংবিধানিক এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

Originally published by দৈনিক ইত্তেফাক, July 25, 2024.

The content of this article is intended to provide a general guide to the subject matter. Specialist advice should be sought about your specific circumstances.

See More Popular Content From

Mondaq uses cookies on this website. By using our website you agree to our use of cookies as set out in our Privacy Policy.

Learn More